আজকের লেখাটা
আরো কয়দিন আগে লেখা উচিৎ ছিল। হয়ে ওঠেনি। জীবিকার তাগিদে করা চাকরি, সময় বের করতে
না পারা, নানারকম অজুহাত দেয়া যায়। আজ একদিন ছুটি পেলাম। লেখার সুযোগ। এটা অনেকটা
স্মৃতিকথা জাতীয় প্রবন্ধ হবে। আমার ছেলেবেলায় লেখালেখির শুরু, বর্তমানে যা ব্লগে
রূপ নিয়েছে তার ইতিকথা বলতে যাচ্ছি।
হুমায়ূন
আহমেদ, বাংলাদেশে এরকম জনপ্রিয় লেখক আমি দেখিনি। নিন্দুকেরা বলেন তার লেখা
একঘেঁয়ে। বাজারী লেখা, ঐতিহাসিক কোন মূল্য এসব লেখার থাকবে না। কথাটা আমি ঠিক তুড়ি
মেরে উড়িয়ে দিচ্ছি না। আবার স্বীকারও করছি না। মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করাই
বুদ্ধিমানের কাজ। আমি কি বুদ্ধিমান ? নাহ, নিজেকে নিয়ে সে অহঙ্কার নেই।
ছেলেবেলায়
বাবা বই কিনে দিত। ইন্ডিয়ান লেখকদের ভূতের গল্প প্রাধান্য পেত। পাশাপাশি ছিল কিশোর
পত্রিকা, কিশোর তারকালোক ইত্যাদি। সেবার তিন গোয়েন্দাও ছিল আমার পাঠ্য বইয়ের
তালিকায়। স্কুলের টেক্সটবুক বাবা পড়িয়ে দিত, এছাড়া সেগুলোর কাছেও যেতাম না। বাবা
নিজের জন্য কিনতো হুমায়ূন আহমেদের বই। শক্ত মলাটের সেই বই আমিও পড়ে ফেলতে শুরু
করি। ওমা, এ যে অন্য অনুভূতি। প্রথম হুমায়ূন আহমেদের কি বই পড়েছিলাম আজ আর মনে পড়ে
না। সেই ১৯৯৩ সালের কথা। টিভিতে দেখা অয়োময় ধারাবাহিকের সুবাদে হুমায়ূন আহমেদ তখন
আমার জন্য অচেনা কেউ নয়। এরপর সে সময় কোথাও কেউ নেই ধারাবাহিক দেখে এই লেখকের
প্রতি ভাললাগা বেড়ে যায়। আর ছিল তার প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত উপন্যাস। হিমু, শুভ্র,
রূপা এরা যেন আমাদের আশে-পাশের মানুষ। ওদের অস্তিত্ব টের পেতে শুরু করলাম। স্কুলের
জন্য কেনা ছোট খাতায় লেখা শুরু করলাম। আমার লেখা সে গল্প (বা উপন্যাস) আবর্তিত
হয়েছিল হায়দার নামক এক চরিত্রকে দিয়ে। টগর, ফুলি আরো কি কি যেন চরিত্র ছিল। ঠিক
যেমন হুমায়ূন আহমেদ লিখতেন। বাবা-মা বেশ গর্ববোধ করেছিল ছেলের এ প্রতিভায় (!)।
হিমু পড়ে লেখা শুরু করি অদ্ভূতুড়ে চরিত্রের ভিতু। যে চরিত্র অনেকটা হিমুর মতো।
পাগলাটে, ক্ষ্যাপা। আম্মুর ডায়েরির পাতায় লিখতে থাকি শিশু মনের ভাবনাগুলো। সেই
শুরু সেই শেষ। পড়ালেখার চাপে, কম্পিউটার-স্যাটেলাইটের আগমনে দূরে সরে যেতে থাকি
লেখালেখির ভূবন হতে। বইয়ের ভূবনও বলা চলে। মাঝে মাঝে পড়তাম তিন গোয়েন্দা, তাও আবার
জৌলুশ হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। ধীরে ধীরে কমে যেতে লাগলো আগ্রহ। কম্পিউটার গেমসে
সময় কাটতে লাগলো।
ইন্টার দিয়ে
কিছু সময় পেলাম। সে সময় শুরু হলো নতুন করে হুমায়ূন আহমেদের বই পড়া। কয়েকটি বই পড়ে
নিলাম। মনে ধরলো কুটু মিয়া বইটি। ভার্সিটির শুরুতেও পড়া চলতে লাগলো। বিশেষ করে
মধ্যাহ্ন বইটা পড়ে খুব ভাল লাগলো। হুমায়ূন আহমেদের অসামান্য সৃষ্টি। সময়কে যেভাবে
ধরে রাখার প্রয়াস, এমন লেখা তেমন দেখিনি। হয়তো আছে, না পড়তে পারা আমার ব্যর্থতা।
মধ্যাহ্নের দ্বিতীয় খন্ডেও দেখলাম মুগ্ধতা। এরপরে আর তার লেখা তেমন পড়া হয়নি, বা
যেগুলো পড়েছি সেগুলো দাগ কাটেনি মনে।
আজ হঠাৎ এসব
লেখার কারণ সে মানুষটি নিজে। হুমায়ূন আহমেদ, যিনি নয় মাস কোলন ক্যান্সারের সাথে
লড়াই করে হার মেনেছেন এক অজানা ভাইরাসের কাছে। ২০১১ সালে তার ক্যান্সার হয়, ২০১২ সালে
জীবনের পরিসমাপ্তি। মাঝের এক বছর তিলে তিলে মানতে শুরু করেছি একদিন হুমায়ূন আহমেদ
চলে যাবেন। অমোঘ এই সত্য এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে ভাবিনি। ভেবেছিলাম লোকটা আরো কটা
দিন বাঁচবেন। লিখবেন মিসির আলী, হিমুদের নিয়ে মধ্যবিত্তের টানা-পোড়েনের গল্প। হয়নি।
তার শেষ একটা লাইন লেখার ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর মুহূর্তে। কি সেই লাইন তা আর জানা হলো
না। উচ্চ মানের ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা অবস্থায় তিনি ছেড়ে গেলেন পৃথিবী।
পূরণ হলো না তার শেষ শখ, লেখক হিসেবে অবসর নেয়ার সাধ।
জীবন বড়ই
বিচিত্র, তার রহস্য ভেদ করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন