আমরা সহজ কথা বুঝতে চাই না, বুঝলেও জল ঘোলা না করে বুঝি না। নিজের কথাই বলি, পড়ালেখা যখন করতাম তখন পরীক্ষায় প্রত্যাশিত নম্বর না পেলে মনে হতো শিক্ষক মহাশয় হয়তো আমার প্রতি রুষ্ট। তাই নম্বর কম দিয়েছেন। নিজে যে পড়ায় ফাঁকি দিয়েছি সেটা বুঝতেই চাইতাম না। তরকারীতে লবণ না হলে লঙ্কাকাণ্ড না বাধিয়ে অনেকেই শান্তি পান না। রন্ধনও যে একটা শিল্প আর তা যে ত্রুটিযুক্ত হতে পারে তা বুঝতে চাই না। রাঁধুনীকে গালাগাল না করলে ভাত হজম হয় না। এসবের অবতারণা করলাম কিছু মনের কথা বলবো বলে। আমি বরাবরই বাংলাদেশের ক্রিকেটের খোঁজ-খবর রাখি। বিশ্বকাপের দল নিয়েও ছিল বিস্তর আগ্রহ। স্থানীয় মিডিয়া, সাবেক ক্রিকেটার, সাধারণ পাঠক সবাই ছিল নানান রকম বিশ্লেষণে ব্যস্ত। যার যার যুক্তিতে সবাই দল সাজিয়েছেন। আমিও বাদ যাই কেন ?
দল নাকি নির্বাচকেরা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। ঘোষণার বাকি ছিল। যাতে নাম ছিল না মাশরাফি বিন মুর্তজার। বর্তমান নির্বাচকদের চক্ষুশূল অলক কাপালী, সৈয়দ রাসেল তো বরাবরের মতোই উপেক্ষিত। তো এই দল বিসিবি অনুমোদন দিতে গিয়েই ঝামেলাটা বাধল। মাশরাফি দলে নাই, তাহলে অভিজ্ঞ অলককে নেয়া হোক। আশরাফুলের ওপরও বিসিবির ভরসা নেই, তাই সেও বাদ পড়ুক। না, নির্বাচক মন্ডলী তা হতে দিবেন না। তাহলে নাকি তারা পদত্যাগ করবেন। দুইদিন ধরে চলল ম্যারাথন মিটিং। দল ঘোষণার শেষ দিনে সকালে আশরাফুল বাদ পড়ে অলক ঢুকছেন আর নির্বাচকেরাও পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন এমন গুঞ্জন ভাসতে লাগল। শেষ পর্যন্ত এমনটি হয়নি। আশরাফুল বহাল তবিয়তে দলে আছেন, বেচারা অলক এবারও উপেক্ষিত থেকে গেলেন। মাশরাফি বাদ পড়লেন ইনসজুরির অজুহাতে।
নির্বাচকেরা কিছু যুক্তি দেখিয়েছেন। দেখা যাক সেগুলো কি:
আশরাফুল : অভিজ্ঞতা, ঘরোয়া ক্রিকেটে দূর্দান্ত পারফরম্যান্স তাই সে দলে। বড় আসরের খেলোয়াড় সে।
অলক কাপালী : সে দুই বছর ধরে দলে নেই, ঘরোয়া ক্রিকেট তেমন কিছু করতে পারেনি। তাই এবার রাখলাম না।
মাশরাফি : ইনজুরি আক্রান্ত বলে ফিট নয়। তাই সে উপেক্ষিত।
যুক্তির পসরা ভালোই সাজাতে পারেন নির্বাচকেরা। আশরাফুল বড় আসরের খেলোয়াড়, এটা ঠিক অস্বীকার করছিনা। তবে বর্তমানে যারা ক্রিকেটের খোঁজ রাখেন তারা জানেন আশরাফুল আমাদের জন্য নারীদের চেয়েও যেন ছলনাময়ী। কখন তার ব্যাট কথা বলবে, কখন তিনি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হবেন কে জানে! তার স্বমহিমা কি সেটাও গবেষণার বিষয় হতে পারে। এক ম্যাচ ভালো করে পরের অনেকগুলো ম্যাচ নিশ্চিত জেনে শীতনিদ্রা দেয়া নাকি ঐ যে কদাচিৎ এক ম্যাচ ভালো খেলা সেটা? ঘরোয়া ক্রিকেটে সবসময় ভালোই খেলে আশরাফুল, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্স কখনোই ভিনদেশী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অনূদিত হয়নি। তবুও তিনি বারবার একই যুক্তিতে দলে আসেন এবং আমরা হতাশ হই। নির্বাচকদের সাথে আছে মিডিয়া, তারা দোষ-গুণের মানুষ আশরাফুলকে শুধু গুণবাচক বিশেষণে বিশেষায়িত করেন। তাই জনগণের প্রবল আপত্তি ধোপে টিকে না, আশরাফুল দলে ঢোকেন আর আমরা মার্কা মারা জনগণ পাড়ায়, কলেজের ক্যান্টিনে আড্ডায় বসে সেসব নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে ব্যস্ত থাকি। একেকজন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ কিনা!
অলক কাপালীর প্রসঙ্গে আসি। এই ছেলের ফ্যান আমি তখন থেকে যখন রেডিওতে ঢাকা লীগের খেলা প্রচার হতো। তখন অলক মনে হয় সদ্য খেলা শুরু করেছে, নিয়মিত রান করছে, উইকেট নিচ্ছে। ভাবতাম ভারতীয় নাকি। পরে তাকে ব্যাট করতে দেখি ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে, টিভির পর্দায় অবশ্যই। তার ব্যাটিং সৌন্দর্যে দারুণ মুগ্ধ হয়ে যাই, তার লফটেড শট, অফ ড্রাইভ, পুল-হুক দারুণ শিহরণ জাগায় তখন। কারণ দলে এমন ছবির মতো সুন্দর ব্যাটিং কেউ করতে পারতো না। তো সেই অলক সময়ের বাঁকে পড়ে দল থেকে হারিয়ে গেল। আশরাফুল যদি বারবার সুযোগ পেতে পারে তাহলে অলক কেন নয় ? আশরাফুল ২০০৫ সালে অসিদের বিপক্ষে করা শতক দিয়ে দলে বারবার আসতে পারলে অলকের আছে ২০০৮ সালে ভারতের সাথে করা শতরান কেন বিবেচনায় আসবে না ? সেই শতরানও যে যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক ছিল তা মিডিয়াও স্বীকার করে। ম্যাচ যেতা হয়নি চারটি ক্যাচ মিস করায়, নাহয় ২৮০ এর ঘরে রান থেকেও দল হারে কি করে ? অলক নেই হয়তো তার লবিং নেই বলে, মিডিয়াও অন্ধের মতো তাকে ভালোবাসে না। একটা তথ্য দিয়ে অলককে নিয়ে কথা শেষ করছি। এবারের লীগে মোহামেডান ৩৩৯ রান করেছিল। সে রান তাড়া করে অলকের গাজী ট্যাংক। ফল কি হয়েছিল জানেন ? গাজী ম্যাচ জিতে নেয় যেখানে অলক করেন ৩৫ বলে ৬৩ রান (অপরাজিত), এত রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড কেউ বের করতে পারলেন না স্মৃতি হাতড়েও।
মাশরাফির ইনজুরি যেমনই হোক তাকে দলে না নেয়ায় খুব আপসেট হইনি। এমনিতেই দুই জন পেসার নিয়ে খেলবে বাংলাদেশ, খেলার মাঝে যদি মাশরাফি আবার বল করতে গিয়ে পড়ে যায় ? কে হবে থার্ড সিমার ? এ উত্তর জানা নেই, তাই এই সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য নির্বাচকদের ধন্যবাদ। মাশরাফির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য শুভ কামনা।
এত কিছু বললাম, যে দল ঘোষিত হলো সেটা নিয়ে কিছু বললাম না। এটা ঠিক হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে দলে ওপেনার আছেন চারজন (তামিম ইকবাল, ইমরুল কায়েস, শাহরিয়ার নাফিস ও জুনায়েদ সিদ্দীক)। এদের মধ্যে তামিম ও ইমরুল ওপেন করবে নিশ্চিত। তবে তিন নাম্বারে জুনায়েদ না নাফিস এই প্রশ্ন আমাকে করলে আমি নাফিসকে বেছে নিলেও সিডন্স সম্ভবত জুনায়েদকেই বেছে নিবেন। তাই নাফিসকে একাদশে দেখতে না পাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। চারে রকিবুল হাসানকে নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকলেও সিডন্সের ভালোবাসায় সিক্ত রকিবুল অটোমেটিক চয়েস। তাই আশরাফুলকেও একাদশের বাইরে থাকতে হবে। এরপর যথারীতি সাকিব, মুশফিক, নাইম, শুভ, শফিউল, রাজ্জাক, রুবেল। এই মোটামুটি দল হতে পারে। তবে এসব প্লেয়ারদের মধ্য হতে আমি দল সাজালে নিম্নরূপ হবে:
তামিম ইকবাল, ইমরুল কায়েস, শাহরিয়ার নাফিস, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, মো: আশরাফুল, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, নাইম ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক, শফিউল ইসলাম ও নাজমুল হোসেন। দলের বাইরে থাকবে জুনায়েদ সিদ্দীক, রকিবুল হাসান, রুবেল হোসেন ও সোহরাওয়ার্দী শুভ। দলে বৈচিত্র্য কম, অলক কাপালীর জন্য আবারো আফসোস হচ্ছে। শুভর জায়গায় সে থাকলে দলটা আরো ব্যলান্সড মনে হতো। বর্তমান দল খুব খারাপ করবেনা, আবার একদম ফাটাফাটি ফল করবে বলে মনে হয় না। তবে একাদশ নির্বাচন ও ব্যাটিং অর্ডার সাজানোয় দক্ষতার পরিচয় যদি ম্যানেজম্যান্ট দিতে পারে তাহলে ভালো কিছু আশা করা যায়। অন্যথায় বাজে রেজাল্টের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
সবশেষে শুভকামনা দলের জন্য। সকল সমালোচনা শেষ হয়ে যাবে দল ভালো করলে। আর যদি নির্বাচকদের একগুঁয়েমিতে দল খারাপ করে বসে তাহলে মানুষের কাছে ভিলেন হয়ে থাকবে নির্বাচক কমিটি ও বিসিবি।
শুক্রবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১১
১৫ জন ক্রিকেটার ও ৩ নির্বাচক সাথে ১ জন সমালোচক
এর দ্বারা পোস্ট করা
Unknown
এই সময়ে
১০:৩৬ AM
এটি ইমেল করুন
এটি ব্লগ করুন!
X-এ শেয়ার করুন
Facebook-এ শেয়ার করুন
লেবেলসমূহ:
অলক কাপালী,
আশরাফুল,
এলোমেলো ভাবনাগুলো,
ক্রিকেট,
নির্বাচক,
বিশ্বকাপ,
মাশরাফই
4 মন্তব্য(গুলি):
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ এর বদলে অলক কাপালী থাকলে ভালো হতো।আর আশরাফুলকে নিয়ে আমাদের আর কোন আশা নেই।
আশা-নিরাশায় ভর করে এবারের বিশ্বকাপ মাঠে গড়ানোর অপেক্ষায় আছি। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
আশরাফুলকে দলে কেন রাখা উচিত নয় এটা নিয়ে ব্লগ-ফোরামে বিস্তর লিখালিখি হচ্ছে, তবে মনে হচ্ছে আমাদের মাননীয় নির্বাচকরা ইন্টারনেট জগতের খবর রাখেন না বা চোখ বন্ধ করে ব্রাউজিং করেন :P
আশরাফুল নামক এক ছলনাময়ীর ছলনায় আমাদের নির্বাচকরা ভুলে গেছেন সব কিছু। তারা অন্তত সামুর নাম তো জানার কথা, সেখানেও প্রচুর সমালোচনা হয় আশরাফুলকে নিয়ে। আমরা লেখা ছাড়া আর কিইবা করতে পারি, এতে যদি মনের ক্ষোভ কমে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন